খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম। পড়াশোনার পাশাপাশি করোনা দীর্ঘ বিরতিতে হয়ে গেছেন উদ্যোক্তা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে খাটি মধুর জন্য অনেকটা নির্ভরতার ঠিকানা হয়েছেন তিনি।

আরিফুল ইসলাম বলেন, ২০০৮ সালে বাবা হঠাৎ রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলে আমার পরিবার মারাত্নক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা শক্তিশালী না থাকার কারনে তখন থেকে কিছু একটা করার চিন্তা ভাবনা প্রায় মাথায় ঘুরপাক খেত। কিন্তু কি করব এবং কিভাবে শুরু করব সেটা বুঝে উঠতৈ পারছিলাম না। এভাবে সময় কেটে যেতে থাকল। কিন্তু সুযোগ টা আসল অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় ২০২০ সালের জুন জুলাইয়ের দিকে।

তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে আমার ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থা তখন খারাপ হয়ে যায়। বাড়িতে বসে অলস সময় কাটাচ্ছি আর পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে বেকার হিসেবে নানা রকম উপাধি পাচ্ছি। ঠিক সেই সময়ে এলাকার এক বন্ধুর সাথে ছোট খাট একটা ব্যবসা করার কথা শেয়ার করলাম। অনেক আলোচনার পর মধুর বিজনেস করার পরিকল্পনা করি।

প্রাথমিক পুজি বলতে যা লাগে সেটা আমার বন্ধু সংগ্রহ করল এবং সম্ভবত আমার পুঁজি ছিল ৫০০/১০০ টাকা। দুইজনে মিলে মোটামুটি ৩০০০/- টাকার মত পুঁজি সংগ্রহ হল। তারপর অনলঅইনে একটা পেজ খুলে ও ফেসবুকে পোষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে ব্যবসা শুর করে দিলাম। পাশাপাশি দুই বন্ধু মিলে প্রচারণা শুরু করে দিলঅম এবং প্রতিষ্ঠানের নাম দিলাম “ফ্রেন্ডস হানি কর্ণার”।

শুরুর দিকে অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, হঠাৎ করে মধু বিক্রি ও খাঁটি মধু চেনা আমার জন্য ছিল সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। কারণ বর্তমান ভেজালের যুগে আমার প্রোডাক্ট কিভাবে কাস্টমারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে উপস্থাপন করব সেটা বুঝতে বুঝতেই কয়েকমাস কেটে গেল। তবে এর মধ্যে অল্প কিছু পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে কিছু পরিমান প্রোডাক্ট সেল দিতে পেরেছিলাম।

আমার ব্যবসাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছি আমার বন্ধুদের। আর পরিবারের ক্ষেত্রে বলব যে তাদের মৌন সম্মতি পেয়েছি কিন্তু অর্থনৈতিক কোন পুঁজি বা সহযোগিতা আমার ব্যবসার ক্ষেত্রে আমি পাইনি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তাদের সন্তান বা ভাই চাকুরি না করে সামান্য ব্যবসায়ী হোক এটা তারা মানতে পারেন নাই।

বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে উদ্যোক্তা বলেন, আমার প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ২ বছর অতিক্রম করেছে। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখন নির্দিষ্ট কিছু কাস্টমানের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্রগ্রাম, জয়পুরহাট, ককক্সবাজার, সিলেট সহ দেশের সব জায়গায় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মধু ডেলিভারি দিয়ে থাকি পাইকারী ও খুচরা। এখন নিজে চলার পাশাপাশি আমার পরিবারকেও সীমিত পরিসরে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা রাখি। এটাই আমার ব্যবসার সবচেয়ে বড় সফলতা আমার কাছে।

তিনি বলেন, নির্দিষ্টভাবে কারো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলেও বিভিন্ন জেলায় কিছু ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা আমাকে কাস্টমার দেন এবং আমি তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন দিই।

যেহেতু পড়াশোনা করলেও চাকুরী থেকে উদ্যেক্তা হওয়াটাকে আমি বেশি প্রাধান্য দিই। এটা আমার ভালোলাগার একটা জায়গা। কোন কাস্টমার যখন ভালো রিভিউ দেন তখন যে প্রশান্তি আমি পাই সেটা কোন চাকুরীতে পাওয়া সম্ভব নয় বলে আমি মনে কার। খাঁটি মধুর চাহিদা অতি প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোন সময়ই কম ছিল না। এক্ষেত্রে সুন্দরবনের মধুর চাহিদা সবথেকে বেশি। তবে ভেজালের ভীড়ে খাঁটি মধুর স্বাদ থেকে অনেক গ্রাহকই বঞ্চিত হচ্ছেন।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে আরিফ বলেন, ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে নির্দিষ্ট পরিমান পুঁজি পেলে সুন্দরবনের খাঁটি মধু সংগ্রহ করার জন্য নিজেই টিম বনিয়ে কাজ করব এবং মৌচাক থেকে সরাসসরি মধু সংগ্রহ করে কাঙ্খিত কাস্টমারের কাছে পৌছে দিব। এবং নির্দিষ্ট একটা অফিস/দোকান ঘর স্থাপন করে অনলাইন ও অফলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করার ইচ্ছা বহুদিনের।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে কাঙ্খিত পুঁজি ও নির্দিষ্ট প্রোডাক্ট সম্পর্কে আইডিয়ার অভাব। তারপরে আছে সামাজিক সমালোচনা ও প্রথম দিকে সেইভাবে মার্কেট না পাওয়া।

বাধাগুলো উৎরে যাওয়ার জন্য প্রথমত দরকার দৃঢ় মনোবল ও সাহস।তারপর পরিবারের সহযোগীতা ও কিছু বিনা সুদে ঋণ পাওয়া গেলে অনেক নতুন উদ্যক্তা তৈরি হওয়া সম্ভব।